দীর্ঘ জুলাই মাস শেষ হলো। শেষ হয়েও শেষ হলো না। রেশ রয়ে গেলো। ছত্রিশ দিনে গিয়ে মাস ঠেকলো। ইতিহাসে ক্যালেন্ডারে কোনো এক মাস এত বড় হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ছব্বিশের জুলাইয়ে ছাত্রজনতা যা করে দেখিয়েছে, তা শুধু এ বাংলাদেশে না বরং পুরো বিশ্বের মানচিত্রেই দেখা পাওয়া বিরল।
কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষেরা বহু কিছু করে দেখিয়েছে যুগে যুগে। তবে ছাত্রজনতা যে ইতিহাস বদলে দিবে তা মোটেও আসেনি কারও কল্পানাতে। জুলাই মাসকে তাই আগস্টে কনভার্ট করতে সকলের ভীষণ অনীহা। আগস্ট মাসের পাঁচ তারিখ কিনা ক্যালেন্ডারের নিয়ম উলটে রাখলো ছত্রিশে জুলাই। কে জানে হয়তো জেন জি বলে কথা।
জুলাইকে আগস্টে নিয়ে আসতে না চাইলেও স্বস্তির আগস্ট নিয়ে এলো অস্বস্তির বন্যা। এমন বন্যাও কেউ কয়েক জনমে দেখে নি। পাহাড়ি ঝর্ণার পাদদেশ থেকে নদীর জন্ম, এবার নাকি সে নদীর উপচে পড়া জলেই পাহাড়ের চূড়াতেও জলে টইটম্বুর।
ফেনীর জনপদ ফেনী নদীর জলে প্লাবিত। ফুয়াদদের বাগিচা দিয়ে পানি ঢুকছে। ততক্ষণে খবর এসেছে পাশের উপজেলা মুহুর্তেই জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। মানুষের ঘর, ভিটা, ফসলি জমি বাদ যাচ্ছে না কিছুই।
খানিক বাদে ফুয়াদদের ঘরে পানি ঢুকে পড়বে। সেসব নিয়ে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। সে ভাবছে দূরবর্তী সীমান্ত এলাকার পানি বন্দি মানুষগুলোর কথা। কিছুক্ষণ ভাবে তো কিছুক্ষণ চুপ মেরে যায়। আবার কিছুক্ষণ ভাবে। ভাবতে ভাবতে সে হতাশ হয় না, বিপ্লবী জুলাই তাকে সাহস যোগায়। এই জুলাইতেই তো কত না জানা গল্প জানা হলো, না পারা গল্প পারা গেলো। রাস্তা থেকে জনপদ, শিশু থেকে বৃদ্ধ, আমি থেকে তুমি, কত আমরা বা আমাদের গল্প এখানে।
এই জুলাই তো কত কিছু উৎখাত করে দিল, কত বিভাজন ঠেলে পাশের বাসার প্রতিবেশী বন্ধু বনে গেল, ডাকাত পাহারা দিতে দিতে তো কত যুগলের উপাখ্যান রচিত হয়ে গেলো। তবে সদ্য ভূমিষ্ট সরকার কি বন্যা সামাল দিয়ে জীবন বাঁচাতে পারবে? ফুয়াদের মনে প্রশ্ন জাগে। ফুয়াদ শংকা আর সন্দেহ পুষে ফেসবুকে স্ক্রল করে। রক্তের মিছিল আর গলিত লাশের গন্ধ পেরিয়ে ফেসবুকে এখন কাঁধে কাঁধে বাঁধ। ওপাড়া থেকে আসা পানির গতি রুখে দিতে বাঁধ কবে মিলবে সে উত্তর ফুয়াদের জানা নেই। তবে ফেসবুক তাকে জানিয়েছে, এবার কাঁধে কাঁধে বাঁধ ততক্ষণে নির্মাণ হয়ে গেছে৷
টিএসসিতে জমা পড়ছে প্রচুর মানুষের ভালবাসা। ভালোবাসা জমা পড়ছে ইসলামী সংগঠনগুলোরও। ফুয়াদ কোনো সাহায্যকে ত্রাণ বলতে রাজী নয়৷ সে ভালবাসার চোখেই এসব দেখে, দেখতে চায়, অন্যকেও দেখাতে চায়। জুলাই তাকে শিখিয়েছে, দেখার ভঙ্গি বদলালে পৃথিবীটাও বদলে যায়। একবার দেখতে শিখে গেলে অনেক আকাঙ্ক্ষার ফসল মাথাচাড়া দিয়ে উঠে শুষ্ক মরুভূমিতেও।
ফুয়াদের বন্ধুরা এদিকে ওদিক ছোটাছুটি করে কাঁধে কাঁধে বাঁধ নির্মাণে পৌঁছে গেছে। সেও মনস্থির করলো ঘরে বসে থাকবে না। অবশ্য সে উপায়ও থাকবে কিনা কে জানে। ঢেলে আসা পানি আর আকাশ থেকে অঝোর কান্নাতে শংকার মেঘ জমেছে৷ এমনও তো হতে পারে আজ রাতেই তলিয়ে যাবে ফুয়াদদের বাড়িঘর হতে সবকিছু। অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে তাদের ইসলামপুর গ্রামের সব দৃশ্য।
আপাতত ফুয়াদের ভাবনাতে ওসব নেই। কোনো রকম একটা ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো ফুয়াদ। এমন সময় কাউকে আটকাতে হয় না। ফুয়াদের মা জানে ছেলেকে আটকালেও লাভ নেই। কথা শুনবে না৷ মা ডাক দিয়ে বলে, কোথায় যাস? গিয়ে ফোন দিস৷ ফুয়াদ ফেরে তাকালো না। তার মা আবার ডাক দেয়। এই শুনে যা, স্যান্ডেলটা পড়ে যা। কথাটা মনে হয় এবার ফুয়াদের কানে গিয়ে বাজলো। ফুয়াদ কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে পড়লো। সবদিকে তো অথৈই পানি, স্যান্ডেল পড়ে কই ভাসাবো? এমনটা বলে তাড়াহুড়ো করে স্থান ত্যাগ করলো।
বাড়ি থেকে বের হয়ে ফুয়াদ আর কোথাও তাকালো না। বাড়ি ছাড়া মানুষের কোনো গন্তব্য হয় না। ফুয়াদেরও আপাতত কোনো গন্তব্য নেই। তবে সে জানে তাকে কোথাও যেতে হবে। এর মাঝে আর থামার সুযোগ নেই। তিন রাস্তার মোড়ে এসে সে দেখলো একটা ট্রাক পানির মাঝ দিয়ে আসছে। কোথায় সড়ক আর কোথায় সড়কের পাশে খাল তা বোঝার উপায় নেই।
হাত দিয়ে ইশারা করে ট্রাক থামালো। ট্রাকের উপরে যারা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তাদের কাউকে ফুয়াদ চেনে না, তাদেরও ফুয়াদ চেনে না। তবে চোখ দেখে ফুয়াদ চিনেছে, এরাও তার মতো জুলাইয়ের কোনো বন্ধু। ফুয়াদ তাদের কাছে জানতে চাইলো, আমাকে নিবে তোমরা? তার চেয়ে কম বয়সী এক তরুণ জবাব দিল, উঠে পড়ুন ভাই। আপনার মতো আমাদেরও গন্তব্য নেই। তবে মাঝপথে জেনেছি এই ট্রাক নোয়াখালীর সুবর্ণচরে যাবে। আসতে আসতে যা পেয়েছি, তা নিয়েই উঠে পড়েছি।
ঘন্টা সাতেক পর ফুয়াদদের ট্রাক এসে দাঁড়ালো এক প্রাইমারি স্কুলের মাঠে। এখন অবশ্য স্কুল না, বহু মানুষের মিলনমেলার মাঝখানে। ফুয়াদ এটাকে আশ্রয়স্থল বলতে রাজী না, সে নাম দিয়েছে ‘'জমায়েত’’। এখানেও নাম না জানা, না চেনা, না দেখা বহু মানুষ আসছে, যাচ্ছে, নিজেরা খিচুড়ি রান্না করে খাচ্ছে। বাচ্চাদের হাতে পুতুল, প্রবীণদের হাতে তসবির জপমালা।
সেদিন রাতে স্কুলের বারান্দাতে কেটেছে ফুয়াদ আর তার বন্ধুদের সময়। সবার চোখেমুখে ঘুম, কিন্তু ক্লান্তি নেই। যারা এখানে জমায়েত হয়েছে তারা জানে না আর কখনো বাড়ি ফিরতে পারবে কিনা। তবু তাদের কোনো অবসাদ নেই। অনেক মুসলমান রোজা রেখেছে। হিন্দু ধর্মের কেউ কেউ মাগরিবের নামাজের সময় এসে তাকে মুড়ির সাথে ছোলা মেখে দিচ্ছে। হিন্দুদের কেউ কেউ উপবাস থেকেছে। মুসলমান একজনের ভাগে পড়া আপেলের টুকরোটা হিন্দু ভাইয়ের প্লেটে তুলে দিচ্ছে। ফুয়াদ ধর্মের নামে দাঙ্গা লাগতে শুনেছিল, কিন্তু এখানে এসে এখন অন্য রকম এক সম্প্রতির বাংলাদেশকে দেখছে।
পরদিন সকালেই ঢাকা থেকে ডাক্তারদের টিম আসবে। ফুয়াদ আর তার বন্ধুরা প্রস্তুত স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার জন্য। কেউ থেমে নেই৷ শুরুর দিকে এখানে বিশুদ্ধ পানি ছিল না। ডায়েরিয়া বেড়ে গেছে। ফুয়াদ তার বন্ধুদের মিলে সবাইকে স্যালাইন গুলিয়ে খাওয়াচ্ছে। অনেকে দ্রুত সেরে উঠছে। কারো একটু বেশি সময় লাগছে। তবে ফুয়াদ আর তার বন্ধুরা হাল ছাড়ছে না। কারো অবস্থা সিরিয়াস হলে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে নৌকায় করে৷ অচেনা এক গ্রামে এসে সবাই চেনা হয়ে গেছে। না হয়েই বা কি হবে। জলের সীমানায় পুরোটাই তো ভেসে যাওয়া জীবন।
এভাবে একদিন দুইদিন করে পাঁচদিন পার হয়ে গেল। অচেনা পরিবেশের মায়ায় পড়ে ফুয়াদ আর তার বন্ধুরা সবাই বাড়ির কথা ভুলে গেছে। ইলেকট্রিসিটি না থাকায় ফোনে চার্জ দিতে পারে নি ফুয়াদ। ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়ির সবার কথা মনে পড়ছে তার। খোঁজও জানতে পারছে না। ততদিনে সুবর্ণচরের পানি নামতে শুরু করেছে। প্রাইমারী স্কুলে জমায়েত হওয়া মানুষজন তাদের ঘরে ফিরবে।
এবার ফুয়াদদেরও ফেরার পালা। নোয়াখালী ছেড়ে আসার সময় জানতে পারে ততক্ষণে ফেনী প্রায় পুরোটা ডুবে গেছে। তার বাড়ির কারো কোনো খোঁজ পাচ্ছে না। কেউ কোথায় আছে তাও জানে না। ফুয়াদ তার চেনা ফেনীতে এসে চেনা মানুষ খুঁজছে। কিন্তু কাউকে দেখছে না।
দূরের এক নারিকেল গাছ প্রায় ডুবে যাচ্ছে। তার উপরে একটি বিড়াল বসা। পানির স্রোত বাড়ছে। হয়তো মিনিট দশেক বাদে সেটাও ডুবে যাবে। বিড়ালটি ফুয়াদের চোখে পড়া মাত্রই সে সাঁতরে নারিকেল গাছটির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে৷ অর্ধেক পথ যেতেই হঠাৎ ফুয়াদ ডুব দিল। কিছু সময় পার হয়ে গেলেও আর উঠছে না। খানিকবাদে ফুয়াদের মতো কেউ একজন ভেসে উঠলো। দূর থেকে তার মুখ চেনা যাচ্ছে না। মুখের পাশ দিয়েই একটি সাপকে দ্রুততম সময়ে পার হতে দেখা গেল।
গল্পঃ জুলাই পরবর্তী আগষ্টের বন্যা
গল্পের ধরণঃ ছোটগল্প
লেখকঃ আমজাদ হোসাইন