কলেজের ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম। নতুন চেহারা, নতুন বন্ধু, নতুন স্বপ্ন। ইফতু
চুপচাপ এককোনায় দাঁড়িয়ে ছিল। সে সবসময় মানুষের ভিড়ে একটু বিচলিত হয়। তার চোখের
ফ্রেমে ধরা পড়ল একটি মেয়ে, রুপা। রুপা যেন ঝড়ের বেগে ছুটে বেড়াচ্ছে, বন্ধুদের
সাথে হাসছে, কথা বলছে। দুজনের চোখাচোখি হলো একবার। ইফতুর চোখে একরাশ মুগ্ধতা।
প্রথমবার তার জীবনে এমন প্রশান্তি অনুভূত হলো।
রুপা তাকে লক্ষ্য করল, হালকা হেসে চোখ ফিরিয়ে নিল। ইফতু ভেবেছিল, এই প্রথম এবং
শেষবারের মতো রুপাকে দেখল। কিন্তু বিধি বাম। কয়েকদিন পর আরেকটি কলেজ প্রোগ্রামে
ইফতু এবং রুপার আবার দেখা হলো। এবার কথাও হলো। "তোমার নাম কী?" রুপা জিজ্ঞেস করল।
ইফতু লজ্জা পেয়েছিল, তবু উত্তর দিল, "ইফতু।"
রুপা তার মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, "আমি রুপা।" গ্রাম থেকে শহরে পড়তে এসেছে জেনে
ইফতুর সারল্য রুপাকে ছুঁয়ে গেল। ইফতুর কথাবার্তা, চালচলনে এখনো গ্রামীণ জীবনের
প্রতিচ্ছবি, বাবার শাসন আর মায়ের আদর মেখে আছে।
ইফতু এবং রুপার কলেজ ছিল একই, কিন্তু ক্যাম্পাস ছিল ভিন্ন। তাই তাদের দেখা হতো না
সচরাচর। কলেজের দুই একটি প্রোগ্রাম ছাড়া কদাচিৎ দেখা হতো। একদিন রুপা ইফতুর কাছে
তার ফেসবুক আইডি চেয়ে বসলো। ইফতু ফেসবুক চালায় না। বোকা ছেলে এই যুগে কেউ ফেসবুক
না ব্যবহার করে থাকে নাকি, এই বলে খানিকটা ধমকের সুরে ইফতুর ফোন নিয়ে ফেসবুক আইডি
খুলে দিল রুপা।
তারপর থেকে মেসেঞ্জারে প্রতিনিয়ত কথাবার্তা হতো ইফতু আর রুপার। কথার চেয়ে গল্পটা
বেশি। দুজনের জীবনের গল্প, রোজকার যাপিত জীবনের গল্প৷ তবে পড়াশোনা নিয়েও কথা হতো
ব্যাপক। ইফতু পড়াশোনা নিয়ে বেশ সিরিয়াস। রুপা এদিকে খানিকটা উদাসীন। কলেজের
সাংস্কৃতিক উৎসব, নাচগান, বিতর্কে তুখোড় রুপা কলেজের পরিচিত মুখ। ইফতু কেবল
পড়াশোনাকেই প্রাধান্য দেয়ায় মাঝেমধ্যে তাদের মেসেঞ্জারের কথাবার্তা হয়ে ওঠতো ঠিক
একধরনের ক্লাসরুম। রুপা কিছু না বুঝলে ইফতু রুপাকে বুঝিয়ে দিত। রুপাও মনোযোগ দিয়ে
তার কথা শুনে। পড়াশোনার কারণে এবার মাঝেমধ্যে তাদের দেখা হবার সুযোগও তৈরি হলো।
কলেজ ক্যাফেটেরিয়াতে টিউশন শিট, নোটবই আর চায়ের চুমুকে গল্প হতো
ইফতু-রুপার৷
রুপা সবসময় উচ্ছল, প্রাণবন্ত। সে ইফতুকে তার জীবনের গল্প, স্বপ্ন, দুঃখের কথা
বলত। ইফতু মনোযোগ দিয়ে শুনত। ইফতুর শৈশবটা ছিল একদম ভিন্ন। সে তার মা বাবার সাথে
গ্রামে বড় হয়েছে, আর রুপা শহরের মেয়ে। দু-চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে শহরে এসেছে ইফতু।
কলেজ শেষ করে একটি নামি-দামি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, তারপর শেষ করে
চাকরি নিয়ে একদিন তার মা-বাবাকে শহরে নিয়ে আসবে। ব্যস, এতটুকুই। এর বেশি
চাওয়া-পাওয়া নেই ইফতুর। ঐদিকে রুপার ইচ্ছে কলেজ শেষ করে বিদেশে পড়তে যাবে। তার
বাবা শহরের ধনীদের তালিকায় থাকা গণ্যমান্য ব্যক্তি। আর্থিক অভাব অনটন নেই,
কোনোকিছু চাওয়া মাত্রই চোখের সামনে এসে হাজির। এই ভিন্নতা সত্ত্বেও তারা একে
অপরকে বোঝার চেষ্টা করত। ইফতুর চোখে মুখে যেমন সারল্য, তেমনি রুপার মনটাও বেশ
নরম। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মালেও যেকোনো মানুষের জন্য তার মন বেশ কোমল,
মানবিক, বিশ্বাসী।
সময় গড়াল। ইফতু এবং রুপা ভালো বন্ধু হয়ে উঠল। ইফতু ধীরে ধীরে বুঝতে পারল যে
রুপাকে তার মনের গভীরে অনুভব করছে। কিন্তু সে কখনো সাহস করেনি রুপাকে তার মনের
কথা বলার। গ্রামের ছেলে বলে হয়তো এই সাহসও চেপে রাখতে চেয়েছে সে। তবে রুপা হয়তো
বুঝত, কিন্তু সেও বুঝে না বুঝার ভান করে থাকতো।
একদিন ক্যাফেটেরিয়াতে ইফতুকে ভয় দেখানোর জন্য রুপা বললো, ‘জানিস ইফতু, আমার বিয়ে
ঠিক হয়ে গেছে। এবার পরীক্ষার পরেই আমার বিয়ে। তারপর বিয়ে করেই বিদেশে আমার বরসহ
পড়তে চলে যাব। তোর কিন্তু আগে থেকেই দাওয়াত রইলো। চলে আসবি কিন্তু।’ ইফতু এ কথা
শোনার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না। কিছু বলার সুযোগও পেল না। তার চোখের কোণে
অশ্রু ছলছল করছে। ইফতুর মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত। রুপা সে ধাক্কার আওয়াজ টের
পায়।
এদিকে ইফতু তার সকল ভালো লাগা, না লাগার অনুভূতি ডায়েরিতে টুকে রাখে। সে জানে
রুপা তার ভালো বন্ধু, কখনো তাকে জনমভর সঙ্গী হিসেবে পাবে না। তবু সে একদিন অন্যের
হয়ে যাবে এমন ভাবনা তাকে কষ্ট দেয়। না পাওয়ার বেদনা তার মনে হাহাকারের জন্ম
দেয়।
এভাবে দেখতে দেখতে কলেজ জীবন শেষের দিকে গড়িয়ে আসছে। পরীক্ষার ব্যস্ততায় ইফতুর
অনলাইনে খুব একটা বেশি আসা হয় না। রুপাও পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠেছে। স্বভাবতই
তারও আগের মতো অনলাইনে আসা কমে গেছে। এদিকে ইফতু ভাবছে দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততায়
হঠাৎ ভাটা পড়েছে রুপা অন্য কারো হয়ে যাওয়ার। তার জন্য বাস্তবতা কঠিন, তবে মেনে
নেয়া যেন আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
দিন পাঁচেক বাদেই ফাইনাল পরীক্ষা। কলেজে সবাই প্রবেশপত্র নিতে এসেছে। ইফতু আর
রুপার পরীক্ষার কেন্দ্র দুজায়গায়। ইফতুর মন খারাপ। সে ভেবেছে এই দেখায় হয়তো তাদের
শেষ দেখা। পরীক্ষার পর রুপার বিয়ে হয়ে যাবে। আর দেখা নাও হতে পারে। দেখা হলেও
হয়তো রুপা আগের মতো প্রাণোচ্ছল নিয়ে কথা বলবে না। অচেনা স্বামীর সামনে ফরমাল
কথাবার্তাতে চলে যাবে। ‘তুমি’, ‘তুই’ থেকে সম্বোধনগুলো ‘আপনি’ পর্যন্ত চলে যাবে।
সেদিনের কথা ভেবে আকাশের কালো মেঘের মতোই ইফতুর মন খারাপ হয়। এদিকে প্রচুর বৃষ্টি
নেমেছে। ছাতাও সাথে নেই। ইফতু দৌড়ে কলেজের ক্যাফেটেরিয়াতে ঢুকলো। নিজে ভিজলে তো
সমস্যা নেই। তবে প্রবেশপথ ভিজলে পরীক্ষা দেয়াই তখন মুশকিল হয়ে যাবে।
ইফতুর দেখায় রুপাও ক্যাফেটেরিয়াতে ঢুকলো। সে ইচ্ছে করেই ইফতুকে মিথ্যা বলেছে।
কিছুটা বাজিয়েও দেখতে চায়। সে দেখতে চায় আসলেই ইফতু তাকে ভালোবাসে কিনা, বাসলেও
কতটুকু। সারাজীবন ভালবেসে আগলে রাখতে পারবে কিনা সেটাও বুঝতে চায় রুপা। তাই ইফতুর
মনে চলমান এক্কাদোক্কার কম্পন এখনই থামাতে চায় না রুপা। সে হৃদয়ের এমন সরল দোলক
ঘুরার কম্পন অনুভব করতে চায়৷ মনে মনে ঠিক করেছে, পরীক্ষাটা যাক। ভালোভাবে শেষ
হোক। তারপর নিজেই ইফতুকে সারপ্রাইজ দিয়ে বলবে তাকে সারাজীবনের জন্য আঁচলে বাঁধতে
চায়।
যথারীতি ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হলো। একে একে লিখিত, ভাইভা শেষ হয়ে গেল। বাকি রইলো
ব্যবহারিক পরীক্ষা। সেটার শেষের দিনে নিজে গাড়ি চালিয়ে ইফতুকে নিয়ে শহরের দূরে
কোথাও চলে যাবে। এমনটা ভেবে ক্যালেন্ডারের দাগ কেটে রাখলো রুপা।
কিন্তু তার অপেক্ষাই যেন আর শেষ হয় না। একেকটি দিনকে এক হাজার বছর মনে হচ্ছে।
ব্যবহারিক পরীক্ষার শেষ দিন। রুপা এক্সাম শেষে কলেজ পুকুর পাড়ে কৃষ্ণচূড়ার গাছের
নীচে অপেক্ষা করছে। হঠাৎ ক্যাফেটেরিয়ার সামনে থেকে চিৎকার এসে পড়লো। মানুষ জড়ো
হতে শুরু করলো। পুলিশ, সাংবাদিক এসে পড়লো। ক্ষমতাসীন দলের চাঁদার ভাগাভাগিতে
গ্যাঞ্জাম বেঁধে এলোপাতাড়ি গুলিতে কলেজের এক ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা
গেছে। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। মানুষের জটলা বেঁধে যাওয়ায় সামনেও আগানো যাচ্ছে
না।
ইফতুকে ফোন দিয়ে যাচ্ছে রুপা। রিং বাজছে। কিন্তু কল রিসিভ হচ্ছে না। রুপা
বৃষ্টিতে ভেজে ভীড় ঠেলে জনসমুদ্রের মাঝে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করলো। বৃষ্টির পানিতে
যে নিথর দেহটি ভিজছে সেটি রুপার চেনা। চেনামাত্র সেও দাঁড়িয়ে থাকলো। নি:শব্দে,
একাকী…
গল্প: নিঃশব্দ হাহাকার
গল্পের ধরণ: ছোটগল্প
লেখক: আমজাদ হোসাইন